তরিকত’ মানে আল্লাহর দিকে বান্দার প্রত্যাবর্তনের পথ। এ পথের দুটি দিক রয়েছে। জাহের ও বাতেন। বাহ্যিক শরিয়ত পালনের মাধ্যমে বান্দা তার জাহেরকে পবিত্র করে আর সঙ্গে সঙ্গে আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে হাকিকত, শরিয়ত ও ধর্ম পালনের নিগূঢ়তম উদ্দেশ্য সাধনে ব্রতী হয়। এই চর্চাই সুফি তরিকার মৌলিক ভাব।
‘তরিকত’ ইসলাম ধর্মে কোনো নব আবিষ্কার নয়। ইসলামের প্রথম যুগে আধ্যাত্মিক সাধনার ছায়ায় তরিকতের হাকিকত বর্তমান ছিল। হজরত রাসুল (সা.) সাহাবাদের ধর্মীয় দিকনির্দেশনার অংশ হিসেবে আধ্যাত্মিক সাধনার তালিম ও তরবিয়াত দিয়েছেন। এমনকি ‘বাইয়াতে ইসলাম’ গ্রহণের পরও সাহাবাদের কাছ থেকে হজরত রাসুল (সা.) বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যাপারে আবার বায়াত গ্রহণ করেছেন।
আল কোরআনে তরিকত চর্চার হাকিকত
রুহানি উৎকর্ষ সাধনের ভিন্ন ভিন্ন পথ ও পন্থার অস্তিত্বের ইঙ্গিত পবিত্র কোরআনেই রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘যারা আমার পথে সাধনা করে, অবশ্যই আমি তাদের আমার অনেক পথ প্রদর্শন করব। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা ইহসানকারীদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা আনকাবুত : ৬৯)। এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা অনেক পথ প্রদর্শন করার কথা বলেছেন।
মাইজভাণ্ডারী তরিকা
ইসলাম ধর্মে আধ্যাত্মিক সাধনার সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় কোরআন ও হাদিসের মৌলিক শিক্ষাকে আশ্রয় ও আত্মস্থ করে অনেক তরিকার আত্মপ্রকাশ ঘটে। যেমন কাদেরিয়া, মুজাদ্দেদিয়া, নকশবন্দিয়া, চিশতিয়া ইত্যাদি। এরই ধারাবাহিকতায় ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কোরআন ও হাদিসের শিক্ষাকে অনুসরণ করে গাউসুল আজম হজরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (কঃ)-এর আধ্যাত্মিক শক্তি ও শিক্ষাকে ধারণ করে একটি তরিকা প্রচারের সূচনা হয়।
এই তরিকার প্রথম বুজর্গ ও প্রচারক গাউছুল আজম হজরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (কঃ) নিজগ্রাম ‘মাইজভাণ্ডার’-এর কারণে ‘মাইজভাণ্ডারী’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাই তাঁর অনুসৃত ও প্রচারিত আধ্যাত্মিক সাধন-পদ্ধতি বা তরিকা ‘মাইজভাণ্ডারী তরিকা’ হিসেবে জনসমাজে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।
মাইজভাণ্ডারী তরিকার মানবকল্যাণকামী বৈশিষ্ট্য
এই তরিকা ছিলছিলার দৃষ্টিকোনে কাদেরিয়া তরিকার সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্যান্য তরিকার আত্মিক ও আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্যগুলো মাইজভাণ্ডারী তরিকায় একত্রিত হয়েছে।
এই তরিকার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এ তরিকা ইসলামী ভাবাদর্শকে পরিপূর্ণভাবে আত্মস্থ করার পাশাপাশি একই সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক, উদার ও সংস্কারমুক্ত, নৈতিক ধর্ম-প্রাধান্যসম্পন্ন, শ্রেণী-বৈষম্যহীন ও মানবদরদী।
মাইজভাণ্ডারী তরিকার কর্মনীতি ও শিক্ষা
ইসলাম ধর্মের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন মাইজভাণ্ডারী তরিকার মূল লক্ষ্য। এ তরিকার কর্মনীতির অন্যতম হচ্ছে খেলাফতপ্রাপ্ত পীরে তরিকতের হাতে বায়াত গ্রহণের পর জিকির চর্চার মাধ্যমে নিজ কলবকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করা। মানুষের মনে ঐশী প্রেম জাগ্রত করে সুন্দর ও ন্যায়ের পথে জীবন যাপনে মানবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করে মানবতার ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তি ও কল্যাণ নিশ্চিত করার শিক্ষা ও দীক্ষা দেয়।
মাইজভাণ্ডারী তরিকার অনুসারীদের প্রতি বর্তমান সাজ্জাদানশীনের দিকনির্দেশনা
বর্তমান আধ্যাত্মিক সাধনায় সফলতা লাভের জন্য শরিয়তের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোরারোপ । মুরিদদের সব সময় জানা দরকার , ‘শরিয়তকে বাদ দিয়ে তরিকত নাই।’ তা হচ্ছে নিয়মিত নামাজ পড়া; রোজা রাখা; সামর্থ্য থাকলে হজ-জাকাত আদায় করা অর্থাৎ শরিয়ত পালন করা।
পরিশিষ্ট : ইসলামী সভ্যতার বিকাশে তাসাউফ চর্চা ও তৎসংশ্লিষ্ট ধ্যান-ধারণার অবদান অনস্বীকার্য। যুগ যুগ ধরে সুফি তরিকাগুলো ইসলামী চরিত্র গড়ার একেকটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় মাইজভাণ্ডারী তরিকা জনসমাজকে ধর্মের মূল সৌন্দর্য্য অবলোকন করিয়ে এর অন্তর্নিহিত শক্তির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। এই কার্যক্রমে ইসলামী চরিত্র অর্জনে যেমন সাহায্য করা হচ্ছে, তেমনি অন্য ধর্মের অনুসারীদের সামনে ইসলামের প্রকৃত আহ্বান ও নীতি তুলে ধরার পথ উন্মোচিত হচ্ছে।
No comments:
Post a Comment