হজ ও ওমরাহ আদায়কারীর জন্য বিশেষভাবে এবং পৃথিবীর সব মুসলমানের জন্য সাধারণভাবে জমজমের পানি পান করা মুস্তাহাব। সহিহ হাদিসে বিধৃত হয়েছে যে নবীজি (সা.) নিজে জমজম থেকে পানি পান করেছেন।
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৫৫৬)
হজরত আবু জর (রা.) বর্ণনা করেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, জমজমের পানি বরকতময়, স্বাদ অন্বেষণকারীর খাদ্য।
(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৪৭৩)
মুসনাদে তায়ালুসিতে এই হাদিসের একটি বর্ধিত অংশ উদ্ধৃত হয়েছেএবং রোগীর ঔষধ। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজের সঙ্গে পাত্রে ও মশকে করে জমজমের পানি বহন করতেন। তা অসুস্থদের ওপর ছিটিয়ে দিতেন এবং তাদের পান করাতেন। (সুনানে তিরমিজি)।
এ বর্ণনা থেকে এ কথাও জানা যায় যে জমজমের পানি বহন করা জায়েজ। আর যারা জমজম কূপের কাছে নয়, তাদের পান করানো নববী সুন্নত।
জমজম থেকে পানি পানকারী ব্যক্তির জন্য সুন্নত হলো পুরোপুরিভাবে পরিতৃপ্ত হয়ে পান করা। ফকিহগণ জমজমের পানি পানের কিছু আদব উল্লেখ করেছেন, যেমনকিবলামুখী হওয়া, বিসমিল্লাহ বলা, তিন শ্বাসে পান করা, পরিতৃপ্ত হওয়া, শেষে আলহামদুলিল্লাহ বলা ইত্যাদি। জমজমের পানি ইবাদত মনে করে পান করা উচিত। জমজমের পানি পান করার সময় একটি বড় কাজ হলো দোয়া করা।
জাবির (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জমজমের পানি যে উদ্দেশ্য নিয়ে পান করবে তা পূরণ হবে।
(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩০৬২)
এ জন্য আমরা পূর্বসূরি মনীষীদের জীবনেতিহাসে দেখতে পাই যে তাঁরা জমজমের পানি পানের সময় বিভিন্ন দোয়া করতেন। এখানে কয়েকজন মনীষীর উদ্ধৃতি দেওয়া হলো
আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রহ.) বলেন, হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি জমজমের পানি পান করেছিলাম স্মৃতিশক্তিতে হাফিজ শামসুদ্দিন জাহাবি (রহ.)-এর স্তরে পৌঁছার নিয়তে। সুয়ুতি বলেন, ইবনে হাজার ওই স্তরে পৌঁছেছিলেন; বরং তাঁর স্মৃতিশক্তি আরো অধিক প্রখর হয়েছিল।
(তাবাকাতুল হুফফাজ : ১/৫২২)
হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) নিজে বলেন, আমার হাদিস শিক্ষাজীবনের প্রথম দিকে একবার আমি জমজমের পানি পান করলাম এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলাম যে তিনি যেন আমাকে হাদিস মুখস্থ করার ক্ষেত্রে হাফিজ জাহাবি (রহ.)-এর অবস্থা দান করেন। তারপর যখন আমি ২০ বছর পর আবার জমজমের পানি পান করলাম এবং ওই স্তর থেকে বেশি কিছুর জন্য প্রার্থনা করতে মন চাইল, তখন আমি আরো উঁচু স্তরের জন্য দোয়া করলাম। আমি আশাবাদী যে আল্লাহ তা-ও আমাকে দান করবেন।
(মাওয়াহিবুল জালিল : ৩/১১৬)
আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রহ.) জমজমের পানি পান করেন এই নিয়তে যে আল্লাহ তাআলা যেন তাঁকে ফিকহশাস্ত্রে ইমাম সিরাজুদ্দিন আল বুলকিনি (রহ.)-এর স্তরে এবং হাদিসশাস্ত্রে হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.)-এর স্তরে পৌঁছে দেন।
প্রসিদ্ধ মুফাসসির আল্লামা ইবনুল আরাবি (রহ.) বলেন, ৪৮৯ হিজরির জিলহজ মাসে আমি মক্কায় অবস্থান করছিলাম। আমি খুব বেশি করে জমজমের পানি পান করতাম। প্রতিবার পানের সময় আমি ইলম ও ঈমানের নিয়ত করতাম। ফলে আল্লাহ তাআলা এর বরকত আমাকে দান করেন এবং আমি যথাসাধ্য ইলম হাসিল করলাম। কিন্তু আমলের নিয়তে জমজমের পানি পান করতে ভুলে গেলাম। হায়! যদি আমলের নিয়তেও পান করতাম, তবে আল্লাহ আমাকে ইলম ও আমল উভয়টির বরকত নসিব করতেন। কিন্তু তা হলো না।
(আহকামুল কোরআন : ৩/৯৮)
আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে জাফর বলেন, হাদিসশাস্ত্রের প্রসিদ্ধ ইমাম ইবনে খুজায়মা (রহ.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, এত ইলম আপনি কিভাবে অর্জন করলেন? প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, নবীজি (সা.) ইরশাদ করেছেন, জমজমের পানি যে নিয়তে পান করা হয় তা-ই কবুল হয়। আর আমি যখন জমজমের পানি পান করেছিলাম, তখন আল্লাহর কাছে উপকারী ইলম প্রার্থনা করেছিলাম।
(সিয়ারু আলামিন নুবালা : ১৪/৩৭০)
শায়খ ইয়াহইয়া ইবনে আহমাদ আল আনসারি (রহ.) কোরআন হিফজের নিয়তে জমজমের পানি পান করেন। ফলে তিনি খুবই স্বল্প মেয়াদে কোরআন হিফজ করতে সক্ষম হন।
হাকিম আবু আবদুল্লাহ (রহ.) জমজমের পানি পান করেন উত্কৃষ্ট রচনা সংকলনের নিয়তে। ফলে তিনি ছিলেন স্বীয় যুগের সবচেয়ে ভালো মানের লেখক ও সংকলক।
(ফাতহুল কাদির : ২/৩৯৮-৪০০)
কখনো আলেমরা বড় বড় উদ্দেশ্য সামনে রেখে জমজমের পানি পান করতেন। যেমনহাফিজ ইবনে হাজার (রহ.) বর্ণনা করেন, ইমাম শাফেয়ি (রহ.) তীর নিক্ষেপে পারদর্শিতা অর্জনের নিয়তে জমজমের পানি পান করেন। ফলে প্রতি ১০টি তীরের ৯টিই তিনি লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে দিতে পারতেন। (ফায়জুল কাদির : ২/৫০৭)
হাফিজ সাখাওয়ি (রহ.) ইবনুল জাজারি (রহ.)-এর জীবনালোচনায় লেখেন, তাঁর পিতা ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। ৪০ বছর পর্যন্ত কোনো সন্তান লাভ করেননি। এরপর তিনি হজে গেলেন এবং পুণ্যবান সন্তান পাওয়ার নিয়তে জমজমের পানি পান করলেন। পরে এক রাতে সালাতুত তারাবির পর মুহাম্মাদ আল জাজারির জন্ম হয়। আর জ্ঞান-গরিমায়, বিশেষত কিরাতশাস্ত্রে ইবনুল জাজারি (রহ.)-এর যে শীর্ষ অবস্থান ছিল, তা তো বিজ্ঞজনের জানাই আছে। (আল গায়াহ : ১/৫৮)
কোনো কোনো আলেমের ব্যাপারে বর্ণনা পাওয়া যায় যে যখন তিনি জমজমের পানি পান করেন, দোয়া করেন, ইয়া আল্লাহ! আপনার নবী আমাদের বলে গেছেনজমজমের পানি যে নিয়তে পান করা হয় তা-ই কবুল হয়। ইয়া আল্লাহ! আমি এই জমজমের পানি পান করছি, যেন কিয়ামত দিবসে তৃষ্ণার্ত না হই। (আখবারু মক্কা : ২/৩২)
লেখক : আলোচক, ইকরা টিভি, লন্ডন
______________________________________
জমজমের পানি দাঁড়িয়ে পান করতে হয় কেন?
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। একজন মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এবং সকালবেলা ঘুম থেকে উঠার পর দিন শেষে আবার ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত গোটা জীবনের সব ধরনের কাজের দিক-নির্দেশনা ইসলামে প্রদত্ত হয়েছে।
ইসলামের কিছু বিধান এসেছে সরাসরি আল্লাহ মহানের পক্ষ থেকে। যাকে আমরা পবিত্র কুরআনের মাঝে পেয়ে থাকি। এছাড়া ইসলামের আরো কিছু বিধান সাব্যস্ত হয়েছে ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবন যাপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
তবে জেনে রাখার বিষয় হলো- রাসূলের (সা.) জীবন যাপন প্রক্রিয়াও মূলত আল্লাহ মহানের নির্দশনায় বাস্তবায়িত হয়েছে।
মুসলিম সমাজে এখন পবিত্র হজের পবিত্র আবহ বিরাজ করছে। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে অনেকেই সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছেন।
পবিত্র হজ পালনের মৌসুমে কিছু বিষয় বা বস্তু নিয়ে বিশ্বব্যাপি আলোচনা হয়। তার মাঝে জমজমের কূপের পানির বিষয়টি অন্যতম। এমন কোনো হাজি সাহেব পাওয়া যাবে না, যিনি হজ শেষে পবিত্র এই কূপের পানি সঙ্গে করে না নিয়ে আসেন।
জমজম কূপের পানি আল্লাহ মহান প্রদত্ত একটি নেয়া্মত। আমরা জানি, সাধারণত পানি বসে পান করা সুন্নাত। কিন্তু জমজমের পানি দাঁড়িয়ে খাওয়ার বিধান রয়েছে ইসলামে। এটা কেন? এই বিধান কতটুকু কোরআন-হাদিস সম্মত?
সাধারণত বা স্বাভাবিক নিয়মে পানি বসে পান সুন্নাত। এ ব্যাপারে রাসূল (সা.)-এর হাদিস রয়েছে এবং এ বিষয়টির প্রতি রাসূল (সা.) গুরুত্বারোপও করেছেন।
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) দাঁড়ানো অবস্থায় পানি পান করাকে তিরস্কার করেছেন।
(মুসলিম শরীফ ৫১১৩, বাংলা, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত)
এছাড়া হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন- তোমাদের কেউ যেন দাঁড়িয়ে পান না করে। (মুসলিম শরীফ ৫১১৮, বাংলা, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত)
সুতরাং পানি বসে খাওয়া সুন্নাত এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ বা সমস্যা নেই।
এখন প্রশ্ন হলো জমজমরে কূপের পানি বসে পান করতে হবে নাকি দাঁড়িয়ে পান করতে হবে- এ ব্যাপারে ইসলামি দিক-নির্দেশনা কী?
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলকে (সা.) জমজমের পানি পান করিয়েছি। তিনি তা দাঁড়িয়ে পান করেছেন।
[বুখারি ১৬৩৭, ৫৬১৭,
মুসলিম ২০২৭,
তিরমিযি ১৮৮২]
এছাড়া রাসূল (সা.) থেকে আরো আলোচনা পাওয়া যায়। হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন- জমজমের পানি যে জন্য পান করা হয়ে থাকে; তা সে জন্যই হবে। অর্থ্যাৎ জমজমের পানি পান যে উদ্দেশ্যে পান করা হবে তাই পূর্ণ হতে পারে।
(সুনানে ইবনে মাজাহ, ৩০৬২;
মুসনাদে আহমাদ, ১৪৮৪৯)
No comments:
Post a Comment