প্রসঙ্গ: পবিত্র আহলে বাইতের ফযিলত.....
ভূমিকা: নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেমন সমস্ত নবীগণের সরদার, হুযুরের পবিত্র আহলে বাইতও তেমনিভাবে পূর্ববর্তী সমস্ত নবীগণের আহলে বাইতের সরদার। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবাগণও পূর্ববর্তী নবীগণের সাহাবাদের সরদার। হুযুরের সম্মানিত পিতা - মাতা সমস্ত নবীগণের পিতা- মাতার সরদার। তবে যেসব পিতা নবী ছিলেন - তাঁদের ফযিলত অবশ্যই উর্দ্ধে। হুযুরের পবিত্র শহর অন্যান্য নবীগণের শহর হতে উত্তম। হুযুরের রওয়া মোবারক অন্যান্য নবীগণের রওযা মোবারক হতে উত্তমতো বটেই - বরং আরশ মোয়াল্লা হতেও অধিক উত্তম। (ফতোয়ায়ে শামী) মোট কথা - হুযুরের সাথে সম্পর্কযুক্ত সব বস্তুই অন্যান্য সবকিছু থেকে উত্তম। ইহাই সার কথা। সুতরাং নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র আহলে বাইতও সকল আহলে বাইতের চেয়ে অধিক উত্তম। পবিত্র কুরআনে ও হাদীসে আহলে বাইতের অসংখ্য ফযিলত ও মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে।
পবিত্র কুরআনে আহলে বাইতের ফযিলত ও পরিধি:
১। বাংলা উচ্চারণ: ”ইন্নামা ইউরিদুল্লাহু লি - ইউযহিবা আ'নকুমুর রিজছা আহলাল বাইতি! ওয়া ইউত্বাহহিরাকুম তাত্বহীরা।” (সূরা আহযাব- ৩৩ আয়াতের অংশ বিশেষ)।
অর্থ: ”হে আহলে বাইত (নবীর পরিবারবর্গ) ! আল্লাহ তো ইহাই চান যে, তোমাদেরকে অপবিত্রতা থেকে দূরে রাখেন এবং তোমাদেরকে উত্তমরুপে পাক - পবিত্র করেন।” (হুযুরের আহলে বাইতের ব্যাখ্যা পরে দেয়া হবে)।
২। বাংলা উচ্চারণ: ”ক্বুল লা - আছআলুকুম আলাইহি আজরন ইল্লাল মাওয়াদ্দাতা ফিল ক্বুরবা” (সূরা শুরা, আয়াত - ২৩)
অর্থ: ”হে প্রিয় নবী; বলে দিন - আমি তোমাদের কাছে নবুয়তের বিনিময়ে কোন প্রতিদান চাইনা। শুধু আমার নিকটজনদের প্রতি মহব্বত কামনা করছি”। (হযরত আলী, বিবি ফাতেমা, হাসান - হোসাইন সহ হুযুরের নিকটজন) - হাকিম, আহমদ ও তাবরানী।
৩। বাংলা উচ্চারণ: ”ফাকুল তা'আলাও নাদউ আবনা আনা ওয়া আবনা আকুম ওয়া নিছা আনা ওয়া নিছা আকুম ওয়া আনফুছানা ওয়া আনফুছাকুম ছুম্মা নাবতাহিল”। (সূরা আলে -ইমরান, ৬১ আয়াত)।
অর্থ: ”হে প্রিয় নবী! ঘোষণা করে দিন, হে নাসারাগণ - এসো। আমরা ও তোমরা নিজ নিজ সন্তানগণকে, স্ত্রীগণকে এবং নিজেদেরকে নিয়ে আসি। অত:পর আমরা মোবাহালা করি।”
নোট: খ্রিষ্টানদের সাথে উক্ত মোবাহালা বা মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ হয়েছিল।
৪। বাংলা উচ্চারণ: ”ওয়া'তাছিমু বি - হাবলিল্লাহি জামি'আওঁ ওয়ালা তাফাররকু”। (সূরা আলে - ইমরান, আয়াত - ১০৩)।
অর্থ: ”হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে শক্ত করে ধর এবং বিচ্ছিন্ন হয়োনা।” সওয়ায়েকে মুহরিকা শরীফে আল্লাহর রজ্জু বলতে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আহলে বাইতকে বুঝানো হয়েছে।
৫। বাংলা উচ্চারণ: ”ইউফুনা বিন নাযরি ওয়া ওয়াখাফুনা ইয়াওমান শাররুহু মুছতাতীরা”। (সূরা দাহার, ৭ আয়াত)।
অর্থ: ”ওরা মানত পূরণ করে এবং ঐ দিনের ভয় করে - যে দিন বিপত্তি হবে ব্যাপক।”
হযরত আলী, ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা, হাসান ও হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা - এর শানে উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে।
৬। উচ্চারণ: ”ওয়া ইজ গদাওতা মিন আহলিকা তুবাউ ইবুল মোমিনিনা মাক্বাইদা লিল ক্বিতালি”। (সূরা আলে - ইমরান, ১২১ আয়াত)।
অর্থ: ”হে রাসুল! স্মরণ করুন - ”যখন আপনি আপনার পরিবারবর্গের নিকট হতে অতি প্রত্যুষে বের হয়ে জেহাদের জন্য মুমিনগণকে যুদ্ধের ময়দানে বিন্যস্ত করেছিলেন”।
উহুদের যুদ্ধে যাবার সময় হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা এর গৃহ হতে তিনি বের হয়েছিলেন। তাই বিবি আয়েশাকে উক্ত আয়াতে আহলে বাইত বলা হয়েছে।
হাদীস শরীফে আহলে বাইতের ফযিলত ও পরিধি:
১। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন: ”আমি আল্লাহর নিকট থেকে এই প্রতিশ্রুতি পেয়েছি যে, আমার উম্মতের মধ্যে যে মহিলার সাথে আমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবো - অথবা যার সাথে আমার সন্তানদের বৈবাহিক সম্পর্ক হবে, সে আমার সাথে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (তবরানী, হাকিম - হযরত আবু হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে)।
২। হুযুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন: ”কোন ব্যক্তির অন্তরে ঈমান প্রবেশ করবেনা - যতক্ষন না সে আমার পরিবারবর্গ এবং আমার নিকটজনদেরকে - মহব্বত করবে ”। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে: ”কোন বান্দা আমার উপর বিশ্বাসী বলে বিবেচিত হবে না - যে পর্যন্ত সে আমাকে ভাল না বাসবে এবং ততক্ষন আমাকে ভালভাসার দাবী করতে পারবে না - যতক্ষন না সে আমার আহলে বাইতকে (পরিবারবর্গকে) ভালোবাসবে”। (ইবনে মাজাহ - হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত)
৩। নবী করিম রাউফুর রাহিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন: ”আল্লাহকে ভালবাস। কেননা তিনিই তোমাদেরকে আপন নেয়ামত দ্বারা খাদ্য সংস্থান করেছেন। আর আমাকে মহব্বত করো- আল্লাহর মহব্বত প্রাপ্তির জন্য এবং আমার আহলে বাইত বা পরিবারবর্গকে ভালবাস - আমার ভালবাসা প্রাপ্তির জন্য ”। (তিরমিজি ও হাকিম - ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত)।
৪। হুযুর আকরাম নূরে মুজাচ্ছাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন: ”তিনটি বিষয়ে তোমরা আপন সন্তানগণকে আদব শিক্ষা দিবে - (১) তোমাদের নবীর প্রতি মহব্বত (২) নবীর আহলে বাইতের প্রতি মহব্বত (৩) কোরআন মজীদ তিলাওয়াত”। (দায়লামী শরীফ)
৫। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছেন: ”নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবন সায়াহ্নে এ কথা বলে গেছেন - তোমরা আমার আহলে বাইতের ব্যাপারে আমাকে তোমাদের প্রতিনিধি মানিও।” (তাবরানী শরীফ)।
৬। আল্লাহর প্রিয় হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন: ”আল্লাহর নিকট তিনটি সম্মানিত বস্তু রয়েছে - যারা এগুলোর সম্মান ও হেফাযত করবে - আল্লাহ তায়ালাও তাদের দ্বীন দুনিয়া - উভয়টির হেফাযত করবেন। আর যারা এগুলোর সম্মান ও হেফাযত করবে না, আল্লাহও তাদের দ্বীন - দুনিয়ার হেফাযত করবেন না।” আরয করা হলো - ঐ তিনটি বস্তু কি? হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন – ”(১) ইসলামের হেফাযত ও সম্মান, (২) আমার সম্মান এবং (৩) আমার নিকটাত্মীয়গণের সম্মান ” (তাবরানী ও আবুশ শাইখ)।
৭। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন: ”কোন বান্দাই প্রকৃত ঈমানদার হতে পারবে না - যে পর্যন্ত আমি তার নিজের আত্মার চেয়েও বেশী প্রিয় না হবো এবং আমার আহলে বাইত তার পরিবারবর্গের চেয়ে বেশী প্রিয় না হবে এবং আমার পরিবার তার পরিবারের চেয়ে বেশী প্রিয় না হবে” (বায়হাকী ও দায়লামী শরীফ)।
৮। হযরত আবু বকর সিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহ আনহু সর্বদা একথা বলতেন: ”আমার আত্মীয়স্বজনদের প্রতি সদ্ব্যবহার করার চাইতে হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আত্মীয়স্বজনদের প্রতি বেশী সদ্ব্যবহার করাই আমার নিকট অধিক পছন্দনীয়” (বুখারী শরীফ)।
৯। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন: ”আওলাদে রাসুলের (আলে মুহাম্মাদ) পরিচিতি দোযখ থেকে পরিত্রানের উছিলা, আলে রাসুলের প্রতি মহব্বত পোষণ করা পুলছিরাত অতিক্রমের মাধ্যম এবং আলে রাসুলের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করা আযাব থেকে নিরাপত্তার গ্যারান্টি” (কাজী আয়াযের শিফা শরীফ)।
১০। হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন: ”আমি আল্লাহর নিকট এই প্রতিশ্রুতি পেয়েছি যে - আমার পরিবারবর্গের (আহলে বাইত) কেউ দোযখে যাবেনা”। (আবুল কাশেম ইমরান ইবনে হাসীন থেকে বর্ণিত)।
১১। হাবীবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন - ”আমার আহলে বাইতের সাথে যে যেরকম আচরণ করেছে - এর প্রতিদান আমি তাকে কেয়ামতের দিন সেরকম দেবো” (ইবনে আসাকির - হযরত আলী সূত্রে বর্ণিত)।
১২। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন - ”নিশ্চয়ই আমার আহলে বাইত নূহ নবী আলাইহিস সালাম এর কিস্তির মত। যে ঐ তরীতে আরোহণ করেছে -সে নাজাত পেয়েছে এবং যে বিরত রয়েছে -সে ডুবে মরেছে” (হাকিম - হযরত আবু যর সূত্রে বর্ণিত)।
১৩। হুযুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন - ”ঐ ব্যক্তির উপর খোদার ক্রোধ আপতিত হোক - যে আমার আহলে বাইতকে জ্বালাতন করে ও কষ্ট দেয়। সে আমাকেও কষ্ট দেয়।” (দায়লামী - হযরত আবু সাঈদ খুদরী থেকে বর্ণিত)।
১৪। হুযুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন - ”যে ব্যক্তি আলী, ফাতেমা, হাসান ও হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা এর সাথে যুদ্ধ করে - আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধরত এবং যে ওদের সাথে সন্ধি করে - আমিও তার সাথে সন্ধি বদ্ধ”। (তিরমিজি, ইবনে মাজা, হাকিম প্রমূখ)।
১৫। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন - ”যে আমার প্রতি, হাসান ও হোসাইনের প্রতি এবং তাদের মাতা - পিতার (ফাতিমা - আলী) প্রতি মহব্বত পোষণ করে - সে জান্নাতে আমার সাথী হবে”। (তিরমিজি ও আহমদ - হযরত আলী সূত্রে)
১৬। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন - ”কেয়ামতের দিনে বংশগত ও বৈবাহিক সূত্রের সকল বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে (কোন উপকারে আসবেনা)। কিন্তু আমার বংশগত বন্ধন ও বৈবাহিক বন্ধন ছিন্ন হবে না (উপকারে আসবে)” (ইমাম আহমদ ও হাকেম)।
১৭। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন - ”আল্লাহ পাক ফাতিমা ও তার সন্তানগণের জন্য দোযখ হারাম করে দিয়েছেন ” (বাযযার - হযরত আবু ইয়ালা সূত্রে এবং তাবরানী - ইবনে মাসউদ সূত্রে বর্ণিত)।
১৮। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন - ”আমি সর্বপ্রথম আমার আহলে বাইতের জন্য সুপারিশ করবো -তারপর নিকটাত্মীয়দের জন্য” (তাবরানী শরীফ - হযরত ইবনে ওমর থেকে বর্ণিত)।
১৯। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন - ”ঐ ব্যক্তি আমার কঠিন ক্রোধে পতিত হবে, যে ব্যক্তি আমার আহলে বাইতের ব্যাপারে আমাকে কষ্ট দেবে।” (দায়লামী শরীফ)।
২০। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন - ”কেয়ামতের দিনে ঘোষণা দেয়া হবে - হে হাশরবাসীগণ! মাথা নিচু করো, চোখ বন্ধ করো - ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুলছিরাতের উপর দিয়ে গমন করবেন। অত:পর ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা সত্তর হাজার হুর পরিবেষ্টিত হয়ে বিদ্যুতের মত পুলছিরাত অতিক্রম করবেন।” (সাওয়ায়েকে মুহরিকা - আল্লামা ইবনে হাজর মক্কী)।
আল্লাহ পাক তাঁর হাবীবের সকল পবিত্র আহলে বাইত ও সকল সাহাবায়ে কেরামের মহব্বত আমাদের নসীব করুন আমীন।
No comments:
Post a Comment