মাইজভান্ডার দরবার শরীফের শরাফতের উল্লেখযোগ্য দিকসমূহ
মানব মুক্তি ও স্রষ্টার নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ) কর্তৃক প্রবর্তিত ও তাঁর মহান জীবন ধারায় প্রতিফলিত মাইজবান্ডার দরবার শরীফের মহান উল্লেখযোগ্য দিকগুলোকে নিম্নোক্তভাবে শ্রেণীবিভাগ করা যায়:
(ক) অর্গলমুক্ত ঐশী প্রেমবাদ কিংবা তৌহিদী শরাফত (Unchained divine love or total commitment to the oneness of almighty Allah)
(খ) আধ্যাত্মিকতা বা আধ্যাত্মক শরাফত (Spiritualism)
(গ) স্রষ্টার অস্তিত্বে বিলীনতা বা আত্ম সমর্পণের শরাফত (Total surrender to the Almighty Allah)
(ঘ) পীরের অস্তিত্বে বিলীনতা বা বিধান ধর্মের শরাফত (Total Dedication to the spiritual guide)
(ঙ) শরীয়তের প্রতি আস্থাশীলতা বা বিধান ধর্মের শরাফত (Adherence to the Principles of Shariah)
(চ) সপ্ত পদ্ধতির বাস্তব প্রয়োগ বা নৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও আত্মশুদ্ধির শরাফত (Practical Application of the Seven Methods or Moral Control and Self-Purification)
(ছ) নির্বিলাস সভ্যতার শরাফত (Simplicity of Life)
(জ) বৈষম্যহীনতা বা বিচার সাম্যের শরাফত (Lack of Discrimination or Judicial Equality)
(ঝ) সার্বজনিনতা বা বিশ্বমানবতার শরাফত (Universality of Global Humanity)
(ঞ) সমাজ সংগঠন বা প্রাতিষ্ঠানিক শরাফত (Social Organization or Institutional Structure)
(ট) সমাজ কল্যাণমূলক কর্মকান্ড বা সামাজিক শরাফত (Social Welfare-Oriented Activities)
(ঠ) রাজনীতি নিরপেক্ষতা বা অরাজনৈতিক শরাফত (Political Neutrality)
(ড) জ্ঞান-চর্চা বা শিক্ষামূলক শরাফত (Knowledge and Education)
(ঢ) কলূষমুক্ত সঙ্গীত বা স্বর্গীয় সুরের শরাফত (Divine Melody)
(ণ) প্রগতিশীলতা বা প্রগতিশীল শরাফত (Progressiveness)
মাইজভান্ডার দরবার শরীফের শরাফতের সুরক্ষায় খাদেমুল ফোকরার অবদান
এখন আমরা মাইজভান্ডার দরবার শরীফের মহান শরাফতের উপরোক্ত দিকগুলোর ক্ষেত্রে অছি-এ-গাউছুল আজম মুর্শিদে বরহক খাদেমুল ফোকরা হযরত মাওলানা শাহ সুফী সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভান্ডারী (রঃ)-এর মহান অবদান সম্পর্কে মূল্যায়ন করার কিঞ্চিৎ প্রচেষ্টা চালাব :
(ক) অর্গলমুক্ত ঐশী প্রেমবাদ কিংবা তৌহিদী শরাফত (Unchained divine love or total commitment to the oneness of almighty Allah)
অর্গলমুক্ত ঐশী প্রেমবাদ বিশ্বমানবতার জন্য হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী(কঃ)-এর একটি দূর্লভ অবদান। নবী করিম (দঃ)-এর নবুয়তের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছির খোদার একত্ব প্রকাশ করা। প্রভূর একত্বে সম্মিলিত হওয়াই হচ্ছে সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য। নবী করিম (দঃ) তাঁর আহম্মদী বেলায়তী শক্তি বলে মহা প্রভূর একত্বে মিলনের পথ আবিস্কার করেছিলেন এবং সে পথ অর্জনের পন্থা নির্দেশ করেছিলেন। মহা প্রভুর এ একত্বে মিলনের পথ হচ্ছে অর্গলমুক্ত ঐশী প্রেমবাদের পথ। অর্গলমুক্ত ঐশী প্রেমবাদ হচ্ছে পবিত্র কোরআন ও হাদীসের মেরুদন্ড ও সুক্ষ্ম উদ্দেশ্য। কলেমা তৈয়বা ও খোদাতলার রহস্য জড়িত আহমদী বেলায়ত পদ্ধতি যা চিরন্তন ও সার্বজনীন। হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ) এর পূর্ববর্তী ওলীগণ ধর্মীয় বিধি-নিষেধের মধ্যস্থতায় সম্প্রদায়গতভাবে উক্ত রহস্য আংশিকভাবে উদঘাটন করতে সক্ষম হলেও জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ধর্মীয় বিরোধ পরিহার পূর্বক বাধাহীন মুক্তির দ্বার উদঘাটন করতে সক্ষম হননি। হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ)ই উক্ত বাধাহীন বেলায়তের একমাত্র দ্বার উন্মোচক ও বাধ্যবাধকতার পরিণতিকারী নিরপেক্ষ তৌহিদবাদ তথা সকল ধর্ম ও তরিকতের গন্তব্য স্থানে পৌছাবার একমাত্র সহজতম উপায়। ইহা যগসম্মত খোদার তৌহিদালোক যা নিরপেক্ষ ও সার্বজনীন এবং আহম্মদী বেলায়তী শক্তির স্বরূপ যা আভ্যন্তরীন ভক্তি-বিশ্বাস ও স্বীকৃতিকে অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করে থাকে।
অছি-এ-গাউছুল আজম এ অর্গলমুক্ত ঐশী প্রেমবাদের সত্যিকার স্বরূপ জনসমক্ষে তুলে ধরার জন্য সুপ্রসিদ্ধ “বেলায়তে মোতলাকা” গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং নিরপেক্ষ তৌহিদের আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন। সকল মানুষকে নিরপেক্ষ তৌহিদের সামিয়ানা তলে সমবেত হবার জন্য তিনি আহবান জানান।
(খ) আধ্যাত্মিকতা বা আধ্যাত্মক শরাফত (Spiritualism)
খোদার একত্বে মিশতে হলে আধ্যাত্মিক প্রেরণা শক্তির একান্ত প্রয়োজন। ইহা বেলায়ত শক্তি অর্জনের একমাত্র অমূল্য সম্পদ। এ দুর্লভ সম্পদ ও শক্তি অর্জনের জন্য রেয়াজন ও কঠোর সাধনা একান্ত প্রয়োজন। সূফী পরিভাষঅ মতে ইহাকে নেছবতে ছকিনা বা স্থায়ী খোদা-সম্পর্ক নামে আখ্যায়িত করা যায়। এই স্থায়ী খোদা সম্পর্কের অভাবে নাছুত মোকামের পার্থিব স্বভাবপ্রবণ মানুষ স্রষ্টার প্রভুত্ব ভুলতে বাধ্য হয়। খোদা-সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সৎ জ্ঞান ও প্রেরণা শক্তির প্রয়োজন। সৎ জ্ঞান ও প্রেরণা শক্তির অভাবে মানব হুদয়ে খোদার প্রতি বিশ্বাস, অনুরাগ ও ভীতির সঞ্চার হয়না এবং সত্যিকার ইসলাম থেমে মানুষ দূরে সরে পড়ে। এই প্রেম-প্রেরণা ও সৎ জ্ঞানের অভাবে মানুষ বিচার বুদ্ধি হারিয়ে অতি বিলাসী হয়ে উঠে এবং অহঙ্কারী ও অত্যাচারী হয়ে নিজেকে ধ্বংসের পথে টেনে নেয়। তাই হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ) বিশ্ববাসীকে ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে খোদায়ী প্রেম প্রেরণায় বেলায়তী শক্তি অর্জনপূর্বক খোদার সাথে নৈকট্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য প্রেম-প্রেরণা (হাল ও জজবা) উন্মুক্তভাবে দান করতেন। তাঁর কাছে যে কেউ উপস্থিত হতো, সে তাঁর আধ্যাত্মিক প্রেরণা বা ফয়েজ রহমত থেকে কখনও বঞ্চিত হত না। অনেকের এত্তেহাদী ফয়েজ অর্জনের সাথে সাথে কাশফ ও জ্ঞানচক্ষু উন্মিলিত হয়ে যেত এবং খোদার গোপন রহস্য জ্ঞান অর্জনপূর্বক বহু ওলীগণে উৎপত্তি ও বিকাশ সাধিত হয়।
অছি-এ-গউছুল আজম ছিলেন এ জজবাতি প্রেম-প্রেরণার ধারক ও বাহক। তিনি কঠোর সংযম ও রেয়জত সাধনা করতেন এবং জজবাতি প্রেম-প্রেরণায় বিভোর হয়ে গভীর রাতে খোদার জিকিরে মশগুল থাকতেন।
(গ) স্রষ্টার অস্তিত্বে বিলীনতা বা আত্ম সমর্পণের শরাফত (Total surrender to the Almighty Allah)
স্রষ্টার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন, চূড়ান্তভাবে আত্মসমর্পণ এবং সৃষ্টার নৈকট্য অর্জনই হচ্ছে মাইজভান্ডার দরবার শরীফের মহান শরাফতের প্রধান লক্ষ্য। স্রষ্টার নৈকট্য অর্জন করতে হলে স্রষ্টা কর্তৃক নির্ধারিত পন্থায় জীবন যাপন করা উচিৎ এবং লাগামহীনভাবে দুনিয়ার প্রতি মোহান্ধ না হয়ে খোদার ইবাদত বন্দেগী করা উচিৎ। বস্তুতঃ পক্ষে স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির মিলনই হচ্ছে সৃষ্টির মূল লক্ষ্য। স্রষ্টার ইবাদতের মাধ্যমেই এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব, যেহেতু ইবাদত বা স্রষ্টার আরাধনা হচ্ছে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে সংযোগ তথা সেতু বন্ধনের প্রধান চাবিকাঠি। প্রকৃতপক্ষে, পীরের চেহারা মোবারক স্মরণে রেখে অন্তরের মধ্যে সন্তোষ সৃষ্টির মাধ্যমে খোদার ইচ্ছাশক্তির উপর নির্ভরশীল হওয়া এবং প্রতিনিয়ত খোদা-স্মরণে মশগুল থাকা প্রতিটি ওলী-প্রেমিক জনগণের একান্ত কর্তব্য। মানুষের জীবন সংকীর্ণ ও ক্ষণস্থায়ী। সুতরাং সময়মত স্রষ্টা-প্রেম জাগ্রত না হলে জীবনে সিদ্ধিলাভ করা সম্ভব হয় না। উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত সাধনা সম্পন্ন করতে হবে। অন্যথায় জীবন নদী এক পর্যায়ে স্রোতহীন হয়ে অজস্র শৈবালধামে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।
খাদেমুল ফোকরা (গরীবের বন্ধু, বা ফকিরের খাদেম) অছ-এ-গাউছুল আজম হযরত দেলাওর হোসাইন মাইজভান্ডারী (রঃ) কারও নিকট কোন কিছুর জন্য মুখাপেক্ষী না হয়ে স্রষ্টা প্রদত্ত আত্মশক্তিতে নির্ভর করে নিজ সামর্থ ও বিচারবুদ্ধি মোতাবেক সমস্ত সমস্যার সমাধান করতেন। তিনি খোদার ইচ্ছার নিকট নিজ স্বার্থ ও বুদ্ধিকে নত করে ধৈর্য্যের সাথে সকল ব্যাপারে প্রতীক্ষা করতেন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, একবার তাঁর দোকানের জন্য শহর থেকে ক্রয় করা মালামাল নৌকাসহ ডুবে যাওয়ার সংবাদ শুনে তিনি এতটুকু বিচলিত না হয়ে বলেছিলেন, “আল-হামদু-লিল্লাহ”। সুফী পরিভাষায় এরূপ অভ্যাসকে ফানা আনিল এরাদা বলা হয় এবং এই গুনজ প্রকৃতিকে তছলিম বা রজা বলা হয়। এ প্রসঙ্গে কোরআন পাকের বাণী প্রণিধানযোগ্য-
“তুমি বল, নিশ্চয় আমার আরাধনা ও আমার উৎসর্গ এবং আমার জীবন ও আমার মৃত্যু বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য”। (সুরা-আনয়াম, আয়াত-১৬২)। কোরআন পাকে আরও বলা হয়েছে-“এবং আমরা কেন আল্লাহর প্রতি নির্ভর করব না? এবং নিশ্চয় তিনি আমাদেরকে আমাদের পথসমূহ প্রদর্শন করেছেন এবং তোমরা আমাদেরকে যে যন্ত্রণা দেবে তা অবশ্যই আমরা সহ্য করব এবং আল্লাহর উপরই নির্ভরশীলগণের নির্ভর করা উচিৎ”।(সূরা-ইবরাহিম, আয়াত-১২)।
স্রষ্টার প্রতি তাঁর ছিল প্রগাঢ় আস্থা। যে কোন বিপদে আপদে ধৈর্য্য না হারিয়ে খোদার ইচ্ছার উপরই তিনি সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল ছিলেন। ১৯৬১ সনে চট্টগ্রাম রেলওয়ে হাসপাতালে উপর্যপুরি দু’বার অপারেশনে জীবনাশঙ্কা দেখা দিলেও তাঁর দুঃখ-বেদনা, ভয়-ভীতি না দেখে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকগণ বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে বলেছিলেন, “আপনার কোন মহাশক্তি আছে, না হলে এরকম লোক বাঁচতে পারে না”। প্রকৃতপক্ষে, ধৈর্য্য, সহিষ্ণুতা ও আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতা হচ্ছে হযরত রাসূল করিম (সঃ)-এর অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। শত নির্যাতনের মাঝ দিয়ে মদিনার পথে হিজরতের সময় সওর পর্বত গুহার মধ্যে শত্রুবেষ্টিত অবস্থার সেই চরম সঙ্কটের মুখেও দয়াল নবী হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে সম্বোধন করে বলেছিলেন, “আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়োনা। আমরা মাত্র দু’জন নই, সর্বশক্তিমান আল্লাহতালা আমাদের সাথে আছেন”।
(ঘ) পীরের অস্তিত্বে বিলীনতা বা বিধান ধর্মের শরাফত (Total Dedication to the spiritual guide)
হযরত খিজির (আঃ)-এর রহস্যময় জ্ঞান, হযরত দাউদ (আঃ)-এর অবলুপ্ত সুরের মোহিনী প্রকাশ, হযরত সোলায়মান (আঃ)-এর রাজকীয় ঐশ্বর্য, হযরত ঈসা (আঃ)-এর প্রেমের বাণী, বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (দঃ)-এর বেলায়তী শান আহমদী নামের যুগোপযোগী পদচারণা, প্রখ্যাত ছাহাবী হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ)-এর অনেক না-বলা কথা ও মহর্ষি বিপ্লবী মনুসর হাল্লাজ (রাঃ)-এর প্রেমের আবেশে তৌহিদী চিৎকার এবং সালমান (রাঃ)-এর বিদ্রোহী ভাষাকে অবলম্বন করেই হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ) মাইজভান্ডারী শরাফতের বীজ বপর করেছেন। মাইজভান্ডারী শরাফতের মূল কথা হল প্রেম। প্রেমের মাধ্যমে স্রষ্টার নৈকট্য অর্জন করতে হবে। মাশুকের জন্য আশেকের হৃদয়ে প্রেমের অগ্নিমিখা প্রজ্জ্বলিত করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,
“আমি রহস্যময় ছিলাম, ভারবাসাতে আত্মপ্রকাশ করলাম”। (হাদিসে-কুদসি)।
অছি-এ-গউছুল আজম কেবলমাত্র হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ)-এর অছি ছিলেন না, তিনি ছিলেন হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ)-এর রহস্য এবং হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ) নামক মহাশক্তির প্রতিনিধি বা ছায়ামাত্র ছিলেন। প্রথম জীবনের এতিম অবস্থা, জাগতিক জীবনে নানা বাধা-বিপত্তি, দ্বন্ধ-সংঘাত সবকিছুর মুখোমুখি তিনি হয়েছেন এক মহা সত্যকে (মাইজভান্ডারী শরাফত) প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। তিনি তাঁর সকল জ্ঞান সম্পদ হযরত ছিদ্দিকে আকবর আবু বকর (রাঃ)-এর ন্যায় হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ)-এর জন্য উৎসর্গ করে গেছেন। হযরত গউছুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ)-এর ধারক, বাহক ও অছি হিসেবে তিনি তাঁর (হযরত আকদাছে (কঃ)-এর ) জাহের ও বাতেন বাণী সমূহের সিন্দুক বা দরজা স্বরূপ ছিলেন, যেরূপ হযরত আলী (রঃ) হযরত রসূল করিম (দঃ)-এর জাহেরী ও বাতেনী এলেমের দরজা স্বরূপ ছিলেন। কিন্তু তাঁর জীবনের দিকে আলোকপাত করলে দেখা যাবে যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে কোথাও নেই। অথচ হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ)-এর প্রকাশ, প্রচার, কাজকর্ম, রীতিনীতি সবকিছুর মধ্যেই তাঁর অস্তিত্ব এক উজ্জ্বল সূর্যের ন্যায় দেদীপ্যমান।
(ঙ) শরীয়তের প্রতি আস্থাশীলতা বা বিধান ধর্মের শরাফত (Adherence to the Principles of Shariah)
কোরআন, হাদীস ও সুন্নাহর সাথে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং শরীয়তের বিধান মোতাবেক স্রষ্টার হুকুম আহকাম (যথা: কলেমা, নামায, রোজা, হজ্জ্ব, জাকাত ও অন্যান্য বিধি নিষেধ) মেনে চলা মাইজভান্ডার দরবার শরীফের শরাফতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। উল্লেখ্য যে, হযরত আকদাছ (কঃ) নিয়মিত নামাযে পাঞ্জেগানা আদায় করতেন এবং নফল নামায, কোরআন শরীফ তেলাওয়াত, রোজা পালন ও মোরাকাবা মোশাহেদাতে থাকতেন। নামায ও খোদা-স্মরণ মানুষকে আলোর সন্ধান দেয়। অন্তরের কালিমা বিদূরিত করে। লোভ ও মোহ থেকে বাঁচায়। পর নির্ভরতা দূরীভূত করে খোদা-নির্ভরতা জাগ্রত করে। আত্ম-সন্তুষ্টি এনে দেয়। খোদায়ী ইচ্ছার উপর সবকিছু সমর্পণ করার মনোভাব সৃষ্টি করে। ফলে আর কোন সমস্যাই তখন সমস্যা মনে হয় না। মহান আল্লাহ বলেন,
“হে বিশ্বাস স্থাপনকারী, তোমরা আল্লাহকে অধিকতর স্মরণে রাখ ও স্মরণ করবে; প্রভাতে ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা কর। তিনিও তাঁর ফেরশতাগণ তোমাদের উপর আশীর্বাদ করে থাকেন যেন তিনি তোমাদেরকে আলোকের দিকে বহির্গত করেন এবং তিনি বিশ্বাসীগণের প্রতি অনুগ্রহকারী”। (সুরা – আহজাব, আয়াত: ৪১-৪৩)
মহান আল্লাহ আরো বলেন,
“অতএব তোমরা আমাকেই স্মরণ কর, আমিও তোমাদেরকে স্মরণে রাখব এবং তোমরা আমার নিকট কৃতজ্ঞ হও এবং অবিশ্বাসী হয়োনা”। (সুর – বাকারা, আয়াত: ১৫২) ।
আজকাল কিছু কিছু তথাকথিত মাইজভান্ডারী শরাফতের অনুসারীদেরকে বলতে শোনা যায় যে, মাইজভান্ডারীদের জন্য নামাজ রোজার দরকার হয় না। নাউজু বিল্লাহ। ওরা হচ্ছে ভন্ড ও শয়তানের বংশধর। মাইজভান্ডারী শরাফতের আসল শত্রু। তাদের বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দরকার।
বিধান ধর্মের শরাফত প্রতিষ্ঠার ক্ষত্রে অছ-এ-গাউছুল আজমের অবদান অপরিসীম। অছি-এ-গাউছুল আজম ছিলেন আদর্শ নামাজী ও দ্বীনদার। সুফী মতবাদের ধারক ও বাহক হিসেবে তিনি আজীবন কোরআন ও সুন্নাহ তথা শরার পা’বন্দ ছিলেন। ছোটবেলা থেকে তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ছাড়া ও তাহাজ্জুদ নামাজসহ অন্যান্য নফল এবাদতে নিজেকে সর্বদা মশগুল রাখতেন। তিনি প্রায়সঃ রোজা রাখতেন। মুরীদের প্রতি তাঁর প্রথম উপদেশ ছিল-
“নামাজ পড়, রোজা রাখ, মিথ্যে বলনা, চুরি করনা, জ্বেনা করনা”।
সকলের নামায পড়ার সুবিধার্থে তিনি দরবার শরীফ মসজিদ, এবাদতখানা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। কোরআন তেলাওয়াত তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল।
(চ) সপ্ত পদ্ধতির বাস্তব প্রয়োগ বা নৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও আত্মশুদ্ধির শরাফত (Practical Application of the Seven Methods or Moral Control and Self-Purification)
নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য উসূলে ছাবআ বা সপ্ত পদ্ধতির অনুশীলন হচ্ছে মাইজভান্ডারী শরাফতের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। আত্ম-নির্ভরশীলতা, অনর্থ পরিহার, স্রষ্টার ইচ্ছায় সন্তোষ, সংযম, পরদোষ পরিহার ও নিজ-দোষ ধ্যান, লোভ-লালসা থেকে মুক্তি, নির্বিলাস জীবন যাপন প্রভৃতি কর্ম পদ্ধতি অনুশীলনের মাধ্যমে ষড়রিপু থেকে মুক্তিলাভ হচ্ছে মানব মুক্তির অন্যতম প্রধান উপায়।
সপ্ত-পদ্ধতির প্রসার ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অছি-এ-গাউছুল আজমের ভূমিকা অতুলনীয়। তিনিই সর্ব প্রথম সপ্ত-পদ্ধতির রূপরেখা লিখিত আকারে প্রকাশ করেন এবং উহার খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা করেন। তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমেই সপ্ত-পদ্ধতি সাধারণের মাঝে পরিচিতি ও বিকাশ লাভ করে। তিনি হচ্ছেন সপ্ত-পদ্ধতির বাস্তব মডেল বিশেষ। সপ্ত-পদ্ধতির প্রতিটি কর্ম প্রণালী তিনি বাস্তবে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন। স্রষ্টার প্রতি তাঁর ছিল প্রগাঢ় ভক্তি। তিনি পান, চা, তামাক ইত্যাদি অনাবশ্যকীয় দ্রব্যাদি বর্জন করতেন। তিনি কঠোর সংযম সাধনা করতেন এবং সারা বৎসর নফল রোজা রাখতেন। মহান আল্লাহ বলেন,
“হে বিশ্বাস স্থাপনকারীগণ। তোমাদের উপর রোজা বিধিবদ্ধ হলো যেরূপ তোমাদের পূর্ববর্তীগণের জন্য বিধিবদ্ধ হয়েছিল-যেন তোমরা সংযত হও”।(সুরা – বাকারা, আয়াত-১৮৩)।
তিনি চরম শত্রুকেও উদারতার সাথে গ্রহণ করতেন এবং শত্রু মিত্র নির্বিশেষে জীবনে কাউকে দুর্ব্যবহার করেননি। বিপুল ধন সম্পত্তির অধিকারী হয়েও তিনি ছিলেন সকল প্রকার লোভ লালসামুক্ত। তাঁর অন্তরে স্রষ্টার প্রেম ভালবাসা ছাড়া কোন প্রকার কামনা বাসনা ছিলনা যাহা বেলায়তে খিজরীর অন্তর্গত। মহান আল্লাহ বলেন,
“জেনে রাখ, তোমাদের ধনসম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি বিড়ম্বনা ব্যতিত নহে এবং নিশ্চয় আল্লাহরই নিকট মহান প্রতিদান রয়েছে”। (সুরা-আনফাল, আয়াত:২৮)
তিনি ছিলেন সৎ কর্মানুরাগী। কর্মঠ ও সঞ্চয়ী লোকদেরকে তিনি ভালবাসতেন। তিনি মিতব্যয়ী ছিলেন এবং যে কোন সম্পদকে খোদার রহমত মনে করতেন এবং উহার সর্বাধিক ব্যবহার ও সংরক্ষণ সুনিশ্চিত করতেন। তিনি পরিবার পরিজন ছেড়ে মনে জঙ্গলে গিয়ে বৈরাগ্য সাধনার মাধ্যমে মুক্তি তালাশ করাকে অপছন্দ করতেন। তিনি ছিলেন অতীব দয়ালু ও সহমর্মী। পশুপাখীদের প্রতিও তাঁর দয়া অবারিত ছিল। মোট কথা, সপ্ত-পদ্ধতির পরিপূর্ণ অনুশীলনের মাধ্যমে তিনি নৈতিকতার সকল দিক দিয়ে চরম উৎকর্ষ অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। নবী করিম (দঃ) তাই যথার্থাই বলেছেন, “আমার উম্মতের মধ্যে এমন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন লোকও আছেন যিনি গুণে, হিম্মতে, হেকমতে আমার সমকক্ষ”। হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ) তাই যথার্থই তাঁর আদরের পৌত্র ‘দেলা ময়নাকে’ উপলক্ষ করে বলেছিলেন, “নবাব হামারা দেলা ময়না হ্যায়। ফের আওর কোন নবাব হ্যায়?” অর্থাৎ “হযরত দেলাও হোসাইন মাইজভান্ডারী (রঃ) নবাব। আর নবাব কে আছে?”
(ছ) নির্বিলাস সভ্যতার শরাফত (Simplicity of Life)
নির্বিলাস জীবন যাপন মাইজভান্ডার দরবার শরীফের শরাফতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ) আচারে ব্যবহারে, আহারে-বিহারে, এমনকি প্রত্যেক কাজের ভেতর দিয়ে নর্বিলাস সভ্যতা শিক্ষা দিয়ে গেছেন। নির্বিলাস জীবন যাপন সপ্ত-পদ্ধতির একটি অপরিহার্য অঙ্গ। বিলাসিতা মানুষের মধ্যে অনর্থকতা সৃষ্টি করে। বিলাসিতা মানুষর মধ্যে অতি ব্যয়ের অভ্যাস সৃষ্টি করে এবং অবিচার, জুলুম, প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্ধিতি, দলাদলি, প্রভৃতির জন্ম দেয় যা মানুষকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যায়। খোদা প্রেম প্রেরণা থেকে বিচ্যূত হয়ে একজন অতি বিলাসী মানুষ জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে দুর্ণীতিকে আঁকড়ে ধরে। নির্বিলাস সুফী সভ্যতা হচ্ছে সনাতন ইসলামী সভ্যতা যা মানুষকে নিষ্প্রয়োজনীয় অতিব্যয় ও অপচয় থেকে রক্ষা করে এবং লোভ থেকে বাঁচায়। নির্বিলাস সভ্যতা মানুষের মধ্যে খোদায়ী প্রেরণা সৃষ্টি করে এবং মানুষকে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি থেকে বাঁচায়।
অছি-এ-গাউছুল আজম ছিলেন নির্বিলাস জীবন যাপনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি কনুইর নিম্ন পর্যন্ত লম্বিত সাদা কাপড়ের জামা, সেলাই বিহীন সাদা লুঙ্গি, সাদা টুপী, শীত ও গ্রীষ্মের উপযোগী চাদর এবং পায়ে কাঠের খড়ম ব্যবহার করতেন। তিনি মাটির উপর বিছানায় শয়ন করতে ভালবাসতেন। তিনি আড়ম্বর মোটেও পছন্দ করতেন না। চিঠি পত্রে তিনি ‘খাদেমুল ফোকরা’ বা ‘গরীবের সেবক’ পরিচিতি ব্যবহার করতেন। মহান আল্লাহ বলেন,
“তোমরা জেনে রাখ যে, এ পার্থিব জীবন ক্রীড় ও কৌতুক ভিন্ন নহে এবং এ সাজ-সজ্জ্বা ও পরস্পরের মধ্যে অহংকার এবং ধনসম্পদ ও সন্তান-সন্ততির আধিক্য; ইহা বৃষ্টিধারা সদৃশ সব্জী উৎপাদনকারীকে আনন্দ দান করে, তৎপর উহা বিচুর্ণিত হয়ে যায় এবং পরকালে কঠোর শাস্তি এবং আল্লাহর সান্নিধান থেকে মার্জ্জ্বনা ও পরিতুষ্টি রয়েছে এবং এ পার্থিব জীবন প্রতারণার ভান্ডার ব্যতিত নহে”। (সূরা – হাদিদ, আয়াত : ২০)।
(জ) বৈষম্যহীনতা বা বিচার সাম্যের শরাফত (Lack of Discrimination or Judicial Equality)
মাইজভান্ডার দরবার শরীফের শরাফতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বশেষে যে কোন স্তরের লোক সুবিচার পাওয়ার যোগ্য। উঁচু-নিচু, আশরাফ-আতরাফ, ধনী-দরিদ্র এরূপ কোন ভেদাভেদ মাইজভান্ডারী শরাফতে নেই। অছি-এ-গউছুল আজম বিচার সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন লড়েছেন। সত্য ও ন্যায়ের পথে অটল থাকার কারণে কোন অন্যায় তাঁর সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য যে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলার মুখোমুখি হতেও তিনি কুন্ঠাবোধ করেননি। তাঁর কোন পক্ষপাতদুষ্টতা ছিল না।
(ঝ) সার্বজনিনতা বা বিশ্বমানবতার শরাফত (Universality of Global Humanity)
মাইজভান্ডার দরবার শরীফের শরাফতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিশ্বমানবতা বা মানবতার কল্যাণ। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের মধ্যে ধর্মসাম্য প্রতিষ্ঠিত করা হলো মাইজভান্ডারী দর্শনের বিশেষ একটি তাৎপর্যময় দিক। মাইজভান্ডারী দর্শনের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা সব কিছুরই ব্যাপ্তি হলো বিশ্বব্যপী। সারা বিশ্বের মানুষের কল্যাণ ও ঐক্যে মাইজভান্ডারী দর্শন বিশ্বাসী। আজ মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে যে অশান্তি ও নৈরাজ্য বিরাজ করছে তার প্রধান কারণ হলো অনৈক্য। যদিও সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব ইসলামের অন্যতম প্রধান আদর্শ, তা আজ মুসলিম দেশসমূহে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃপ্রতিম সহযোগিতা, সৌহার্দ পূর্ণ সম্পর্ক এবং ঐক্যই কেবল এনে দিতে পারে সারা বিশ্বে স্থায়ী শান্তি ও উন্নয়ন।
অছি-এ-গাউছুল আজম ছিলেন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নিরপেক্ষ। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর লোকের তাঁর কাছে অবাধ গমনের অনুমতি ছিল। তাঁর কাছে উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র, হিন্দু-মুসলিম এরূপ কোন ভেদাভেদ ছিল না। সকল প্রকারের চরিত্রবান লোককে তিনি আদর যত্ন করতেন এবং মনোযোগ সহকারে তাদের দুঃখের কথা শ্রবণ করতেন। তিনি ছিলেন দুর্গত মানবতার অকৃত্রিম সেবক। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় তিনি নানুপুর, লেলাং প্রভৃতি ইউনিয়নের দুর্গত লোকদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করেন। খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসার দ্বারা তিনি অনেক দুর্গতকে নিজের প্রত্যক্ষ সেবায় সুস্থ করে তোলেন। অনেক অনাথ বালক-বালিকা ও ভবঘুরে তাঁর আস্তানায় লালিত পালিত হয়ে ও শিক্ষা-দীক্ষা লাভ করে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গরীব ও দুঃখী জনকে তিনি মুক্ত হস্তে দান করতেন। বাজারে যখন চড়াদামে দ্রব্য বিক্রয় হতো, তখন তিনি দরবার ষ্টোর থেকে ন্যায্য মূল্যে জনসাধারণের কাছে পণ্য বিক্রয়ের জন্য নির্দেশ দিতেন। আতিথেয়তায় তিনি ছিলেন অনন্য সাধারণ। তাঁর অপূর্ব আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে ১৯৫৯ সালে মার্কিন কৃষি উপদেষ্টা রবার্ট ডব্লিউ ফাউলার (Robert W. Fawler) লিখেছেন, “I am extremely happy to have been a guest in this home of the religious leader and to view the activities of a great festival as is taking place. We are appreciative of your wonderful hospitality.”
অর্থাৎ ‘আমি একজন ধর্মগুরুর বাড়ীর অতিথি হয়ে এবং একটি মহান উৎসবের কর্মকান্ড দেখে অতিশয় খুশী। আমি আপনার অভূতপূর্ব আতিথেয়তায় কৃতজ্ঞ’।
মানবতার কল্যাণের ক্ষেত্রে অছি-এ-গাউছুল আজমের ভূমিকা পর্যালোচনা করলে ইহা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি ছিলেন মাইজভান্ডারী শরাফতের মহান ধারক ও বিকাশধারী। সূর্য যেরূপ চিরভাস্বর, সারা বিশ্বের আনাচে কানাচে আলো ছড়িয়ে দেয়, অছি-এ-গাউছুল আজমও সেরূপ স্থান, কাল, পাত্র ভেদে সকল মানুষের কাছে মাইজভান্ডারী শরাফতের মহান শ্লোগান ‘মানবতার জয়গান’কে ছড়িয়ে দিয়েছেন।
(ঞ) সমাজ সংগঠন বা প্রাতিষ্ঠানিক শরাফত (Social Organization or Institutional Structure)
সমাজকে সংগঠিত করা বা সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সৃষ্টি করা একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য। মাইজভান্ডারী শরাফত তাই সমান সংগঠনের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। সমাজ গঠনের জন্য প্রধানতঃ তিনটি উপাদান প্রয়োজনঃ (১) একটি আদর্শ, (২) সে আদর্শভিত্তিক মজবুত সংগঠন এবং (৩) সে আদর্শ বাস্তবায়নের উপযোগী নেতৃত্ব। অছি-এ-গাউছুল আজম স্রষ্টার মহান ইচ্ছাশক্তিতে বলীয়ান হয়ে সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে সমাজের ঈপ্সিত সংস্কার সাধন করে গেছেন এবং মাইজভান্ডারী শরাফত সুরক্ষার লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বিনির্মাণ করে গেছেন। মনগড়া, ভূয়া রীতিনীতি ও আচার পদ্ধতিতে কুসংস্কারাচ্ছন্ন তরিকতপন্থীদেরকে কলূষ মুক্ত করে সত্যিকারের ইসলাম ও সুফীবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যে এবং পরস্পরের মধ্যে সদ্ভাব ও ঐক্য সৃষ্টির মানসে তিনি গ্রামে গঞ্জে “আঞ্জুমানে মোত্তাবেয়ীনে গাউছে মাইজভান্ডারী” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে গেছে যা তরিকতপন্থী ভাইবোনদের আত্মিক-আধ্যাত্মিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।
(ট) সমাজ কল্যাণমূলক কর্মকান্ড বা সামাজিক শরাফত (Social Welfare-Oriented Activities)
সমাজ কল্যাণমূলক কর্মকান্ডে অংশ গ্রহণ করা একজন প্রকৃত মুমিনের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। মাইজভান্ডার দরবার শরীফের ইহাও একটি বিশেষ দিক। সমাজ ব্যবস্থাকে অধিকতর সুন্দর করার মহান অভিপ্রায়ে যাঁরা জীবন বাজী রেখে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়েছেন অছি-এ-গাউছুল আজম তাদের মধ্যে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। তিনি সমাজের জন্য আজীবন প্রচেষ্টা চালিয়েছেন এবং বহু জনহিতকর প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে মাইজভান্ডার আহমদীয় উচ্চ বিদ্যালয়, ভান্ডার শরীফ আহমদীয় প্রাইমারী স্কুল, নাজিরহাদ আহমদিয়া আলীয়া মাদ্রাসা, নানুপুর গাউছিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা, তফাজ্জ্বল মেমোরিয়ল লাইব্রেরী (সেখানে হযরত আলি (কঃ)-এর রচিত দীওয়ানে আলী, ইবনে আরবী (রঃ)-এর তফছির ও ‘ফছছুল হেকম’, মাওলানা তোরাব আলি কলন্দর রচিত ‘মতালেবে রশীদি’, মাওলানা রুমী (রঃ)-এর মছনবী শরীফ, পীরানে পীর দস্তগীর (রঃ) রচিত কছিদায়ে গাউছে চকলাইন প্রভৃতি অনেক দুষ্প্রাপ্য ও মহামূল্যবান গ্রন্থ সুরক্ষিত আছে) নাজিরহাট রেলওয়ে ষ্টেশনে ওরশ শরীফের যাত্রী ও ট্রেনের সাধারণ যাত্রীদের সুবিধার্থে স্থায়ী শেড, এলাকার জনগণ ও দরবার শরীফের চিঠিপত্র আদান প্রদানের সুবিধার্থে ভান্ডার শরীফ পোস্ট অফিস, চৌমুহনী নতুন বাজার (ফটিকছড়ি), নাজিরহাট-মাইজভান্ডার শরীফ পাকা রাস্তা, শাহ আহমদ উল্লাহ (রঃ) নামের সাথে ‘শরীফ’ শব্দ সংযোজন করে মাইজভান্ডার শরীফ নামকরণের সরকারী অনুমোদন লাভ, গামারী তলা, মাইজভান্ডার শরীফ, কিফায়েত নগর, দক্ষিণ গোপালঘাট্টা, রায়পুর, দমদমা, পূর্ব আজিমনগার গ্রামসমূহের জমির মালিক-চাষীদের সমন্বয়ে ‘সর্ত্তা লেলাং প্রবাহন এলাকায় কৃষ্টি সমিতি প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এ সকল প্রতিষ্ঠানসমুহ তাঁর প্রত্যক্ষ প্রচেষ্ট, উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
মাইজভান্ডার দরবার শরীফের শ্রীবৃদ্ধিকল্পে এবং বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্যে শৃঙ্খলা বিধানের জন্যও তিনি মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন। হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (রঃ) রওজা শরীফের সংস্কার, দরগাহ-এ-গাউছিয়া আহমদিয়া, মেহমানখানা, মঞ্চিলে হোসাইনী, বাগ-এ-হোসাইনী প্রভৃতিও তাঁর উল্লেখযোগ্য কীর্তি। এসব দৃষ্টান্ত থেকে ইহা সুপ্রমানণিত হয় যে, আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি অছি-এ-গাউছুল আজম একজন উচ্চ মার্গের সমাজ সেবক ও সংস্কারক ছিলেন।
(ঠ) রাজনীতি নিরপেক্ষতা বা অরাজনৈতিক শরাফত (Political Neutrality)
মাইজভান্ডার দরবার শরীফ রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব থেকে মুক্ত। কোন প্রকার দলীয় রাজনীতি কিংবা রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় মাইজভান্ডার দরবার শরীফের কর্মকান্ড আবর্তিত হয় না। মাইজভান্ডার দরবার শরীফের সকল কর্মকান্ড আবর্তিত হয় মহান স্রষ্টা কর্তৃক নির্দেশিত এবং নবী করিম (দঃ) কর্তৃক প্রদর্শিত ও হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (রঃ)-এর জীবন ধারায় প্রতিফলিত পথে। অছি-এ-গাউছুল আজমের জীবনধারায় এ নীতির পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন ছিল।
(ড) জ্ঞান-চর্চা বা শিক্ষামূলক শরাফত (Knowledge and Education)
জ্ঞা-চর্চা মাইজভান্ডারী শরাফতের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। হাদিস শরীফে আছে-
“বিজ্ঞান ও জ্ঞানের তথ্যাদি ঘন্টাখানের স্মর্ণ করা এক হাজার শহীদের জানাজা থেকেও অধিকতর পূণ্যের, এক হাজার রাত্রিতে নামাজে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়েও পূন্যতর”।
নবী করিম (দঃ) বলেছেন,
“জ্ঞান অর্জন করো; জ্ঞান তোমাকে মন্দের মাঝে ভালোর সঙ্গে পরিচিত করে তুলবে। জ্ঞান স্বর্গীয় আনন্দ দেবে। মরুভূমিতে জ্ঞান তোমাদের বন্ধু, নির্জনতায় তোমাদের সঙ্গী, পরিত্যক্ত অবস্থায় সে নির্ভরযোগ্য সহচর। জ্ঞান দুঃখে শান্তনাদাতা, সুখের দিক-নির্দেশক বন্ধু, জন সমাগমে অলংকার ও শত্রুর বিরুদ্ধে বর্ম। সুতরাং দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষণ কর। কারণ যে জ্ঞান অন্বেষণ করে, তার অতীতের কৃত পাপ মোচন হয়ে যায়”।
মহান আল্লাহতালার নিকট থেকে ওহী মারফত রসূল (দঃ)-এর প্রতি নাযিলকৃত প্রথম বাণী হচ্ছে “পড়ুন” অর্থাৎ শিক্ষা লাভ করুন। ইহা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, জ্ঞান চর্চা মানুষের জন্য অপরিহার্য। মার্জিত রুচি, পরিচ্ছন্ন ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, আদর্শ রাষ্ট্র গঠন, অসৎ ও অসামাজিক কার্যাবলী বর্জন, ব্যক্তি চরিত্রের পুনর্গঠন, স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয়, দায়িত্ব ও কর্তব্য পরায়ণতা সম্পর্কে সচেতনতা, ইহকালের কল্যাণ ও পরকালে পরিত্রাণ লাভ, চরিত্র গঠন প্রভৃতির জন্য জ্ঞানচর্চা মানুষের অপরিহার্য। ধর্মীয় জ্ঞানহীনতার কারণেই আজ প্রায় অঞ্চলে দুর্ণীতির বন্যা ও চরিত্রহীনতার করাল গ্রাস জনজীবনকে অতীষ্ট করে তুলেছে। সত্যিকার ধর্মীয় জ্ঞানের অভাবে আজ আমরা হারামকে বলি লাভ, ঘুষকে বলি বখশিষ, অন্যায়কে বলি সুবিচার, জুয়াকে বলি লটারী। মাইজভান্ডার দরবার শরীফের শরাফত তাই জ্ঞানচর্চার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে।
অছি-এ-গাউছুল আজম ছিলেন জ্ঞানচর্চার অগ্রনায়ক। মাইজভান্ডার দরবার শরীফের অন্য কোন অলী বা ব্যক্তিত্ব তাঁর মত এত বেশী জ্ঞান চর্চা করেছেন বলে আমার জানা নেই। তিনি ছিলেন একাধারে গবেষক, সাহিত্যিক সমালোচক ও উঁচুদরের লেখক। তিনিই মাইজভান্ডার দরবার শরীফের শরাফতের বিভিন্ন দিক লিখিত আকারে লিপিবদ্ধ করেন এবং পাঠক সমাজের কাছে তুলে ধরেন। তাঁর লেখনিতেই মাইজভান্ডার শরীফের দর্শন পরিস্ফুট হয়ে উঠে। তাঁর প্রকাশনার পূর্বে মাইজভান্ডারী দর্শন সম্পর্কে মানুষের কোন ধারনাই ছিল না। তাঁর রচিত ‘বেলায়তে মোতলাকা’। মূলতত্ত্ব বা তজকিয়ায়ে মুখতাচার, ‘মানব সভ্যতা’, ‘বিশ্ব মানবতায় বেলায়তের স্বরূপ’, ‘রেঁনেসা যুগের একটি দিক’, ‘মিলাদে নববী ও তাওয়াল্লাদে গাউছিয়া’ প্রভৃতি মাইজভান্ডারী দর্শন ও মাইজভান্ডার দরবার শরীফের শরাফত সুরক্ষায় মূল্যবান অবদান রেখেছে। মাইজভান্ডারী দর্শনের বিকাশের ক্ষেত্রে তাঁর এ অবদার চির ভাস্বর হয়ে থাকবে।
(ঢ) কলূষমুক্ত সঙ্গীত বা স্বর্গীয় সুরের শরাফত (Divine Melody)
মাইজভান্ডার দরবার শরীফে স্বর্গীয়সুরের মূর্চ্ছনায় ও ছন্দের বাজনার তালে তালে আধ্যাত্মিক সঙ্গীত গেয়ে খোদার ভাবে বিভোর হয়ে নৃত্যের মাধ্যমে জিকির করার রেয়াজ আছে। কিন্তু বাদ্যযন্ত্রসহ গান গেয়ে নেচে নেচে জিকির করতে হবে এমন কোন কথা নেই। ইহা মাইজভান্ডার দরবার শরীফের শরাফতের অপরিহার্য অঙ্গ নয়, প্রয়োজনীয় শর্তও নয়। যুগ সংস্কারক ওলীয়ে কামেলগণ মানবজাতিকে নানা প্রকার হেকমত প্রয়োগে খোদার প্রতি আহবান করে থাকেন। মহান আল্লাহ বলেন,
“তোমরা দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে বা যে কোন অবস্থায় খোদাকে স্মরণ করো”।
হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ) আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগের বিভিন্ন মজাকীয় বৈজ্ঞানিক রুচি সম্পন্ন বিভিন্ন জাতির ও ধর্মের সমাবেশ ও সংমিশ্রণ স্থলে আবির্ভূত মোজাদ্দেদ ওলী বিধায় তিনি আল্লাহ, রাসুল ও ওলীর শানে গান-বাজনা ও গজল গীতিকে স্থান, কাল, পাত্র ভেদে জিকিরী উপাদান বা হুজুরী কলব (একাগ্রচিত্ততা) সৃষ্টির হেকমত বা কৌশল হিসেবে অনুমোদন দিয়েছেন। তবে এরূপ গান-বাজনা শর্ত সাপেক্ষ।
শর্তগুলো নিম্নরূপ:
(১) গান-বাজনা খোদার জিকিরের নিয়তে হতে হবে।
(২) গানে কোন অশ্লীলতা থাকবে না। উহা সম্পূর্ণরূপে আধ্যাত্মিক বা খোদা, রসূল কিংবা ওলী-প্রেমের সঙ্গীত হতে হবে।
(৩) গান-বাজনাসহ জিকিরকারীদের শরীর পাক হতে হবে এবং অজু থাকতে হবে।
(৪) জিকির-মাহফিল ভ্রাম্যমান হবে না। উহা একটি নির্দিষ্ট জায়গায় হতে হবে।
(৫) কোন উন্মাদ কিংবা অপ্রাপ্ত বয়স্ক লোক জিকির মাহফিলে থাকতে পারবে না।
(৬) গান-বাজনাসহ জিকির আরম্ভের পূর্বে মিলাদ শরীফ ও তাওল্লাদে গাওছিয়া পড়তে হবে এবং জিকির শেষে মুনাজাত করতে হবে।
(৭) খোদার ভাবে নাচ করার সময় কারো গায়ে পড়ে অন্যের ধ্যান ভঙ্গ করা যাবে না।
(৮) জিকিরের সাথে গাঁজা, আফিম, ভাঙ্গ ইত্যাদি খাওয়া যাবে না।
(৯) পথে ঘাটে চাঁদা তোলার কাজ হেঁটে হেঁটে বিনা অজুতে গান বাজনা করা যাবে না।
(১০) কারো লেখাপড়া, ঘুম কিংবা রোগীর শান্তিপূর্ণ অবকাশ যাতে বিঘ্নিত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
(১১) গান-বাজনাসহ জিকির একটি নফল এবাদত। নামাজ, রোজা বাদ দিয়ে শুধু জিকির করা চলবে না।
উপরোক্ত নিয়মকানুন মেনে গান বাজনাসহ জিকির করা হচ্ছে মাইজভান্ডার দরবার শরীফের একটি শরাফত। এর অন্যথা মাইজভান্ডার দরবার শরীফের শরাফতের পরিপন্থী। অছি-এ-গাউছুল আজম তাঁর “মিলাদে নবী ও তাওয়াল্লাদে গাউছিয়া” বইতে গান-বাজনাসহ জিকিরের উপরোক্ত নিয়ম কানুন বর্ণনা করে গেছেন। উল্লেখ্য যে, গাউছিয়া আহমদীয়া মঞ্জিলে গান-বাজনাসহ জিকিরের উপরোক্ত নিয়মকানুন অদ্যাবধি অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়। গান-বাজনাসহ জিকিরের পবিত্রতা রক্ষার ক্ষেত্রে অছি-এ-গাউছুল আজমের এ মহান অবদান প্রশংসনীয়।
(ণ) প্রগতিশীলতা বা প্রগতিশীল শরাফত (Progressiveness)
মাইজভান্ডার দরবার শরীফের শরাফত সকল প্রকার কুসংস্কার এবং গোঁড়ামীর উর্ধ্বে। একজন কামেল ওলীর সত্যিকার খেদমত ও ছোহবত থেকে যারা বঞ্চিত, তারা বেলায়ত সম্বন্ধে অজ্ঞতার দরুণ মনগড়া কাজকর্ম ও কথাবার্তা বলে থাকে। এরূপ শরীয়ত গর্হিত কাজকর্ম ও কথাবর্তা মাইজভান্ডারী শরাফতের সম্পূর্ণ বিরোধী। মহান আল্লাহ বলেন,
“বহু পবিত্র লোকদের পরবর্তী এ রকম লোকও থাকে যারা নামাজ (জাহের ও বাতেন) পড়ে না বা তর্ক করে এবং কামনার বশবর্তী হয়ে অতি শীঘ্র নরকের নিম্নস্তরে পতিত হয়”। (সূরা – মরিয়ম, আয়াত:৫৯) ।
সমাজে কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকদের আধিক্যের দরুণ সমাজের সত্যিকার স্বরূপ ক্রমশঃ বিকৃত হতে থাকে। বিশ্ব বরেণ্য মনীষী মহাত্মা বার্ণাড শ’কে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন,
“আমি কোথায় যাব? যাদেরকে লোকে মুসলমান বলে, মুসলমান ও ইসলাম সেরূপ নহে। ইসলামের সত্যিকার ও মৌলিক সমাজ ব্যবস্থা থাকলে আমি নিশ্চয়ই সে সমাজে যেতাম”।
কুসংস্কার মানুষকে নৈতিক দিক দিয়ে পঙ্গু করে দেয় এবং পাপের পথে ঠেলে দেয়।
উদাহরণ স্বরূপ, কোন কোন তথাকথিত মাইজভান্ডারী (নিজেদেরকে মাইজভান্ডার (রঃ)-এর অনুসারী বলে পরিচয় দেয়, অথচ মাইজভান্ডারী (রঃ)-এর কোন আদর্শ তাদের মধ্যে নেই) কে বলতে শুনা যায়, “মাইজভান্ডারে সত্য, মিথ্যা, আচার, ধর্মের বালাই নেই, বাবার প্রতি ভক্তি রাখলেই মুক্তি নিশ্চিত”। নাউজুবিল্লাহ! এরূপ ভন্ড মাইজভান্ডারী, মাইজভান্ডারী শরাফতের শত্রু। তাদের বিরুদ্ধে মাইজভান্ডারী শরাফত একটি প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। কোরআন-হাদীস-সুন্নাহ বহির্ভূত ও বিবেক বর্জিত কোন কিছুর স্থান মাইজভান্ডারী শরাফতে নেই। ব্যাঙের ছাতার মত যত্র-তত্র এবং যার-তার মাজার গৃহ নির্মাণ ও মাইজভান্ডারী শরাফতের পরিপন্থী, মানুষের দৈহিক সুস্থতা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুস্থতা যেমন প্রয়োজনীয় ও মূল্যবাদ, মানসিক সুস্থতা ও দৃষ্টিভঙ্গীর সুস্থতাও তেমনি প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান।
অছি-এ-গাউছুল আজম ছিলেন সকল প্রকার গোঁড়ামীমুক্ত ও প্রগতিশীল। গণ সভ্যতা ও সমাজ জীবনে ধর্মীয় প্রভাবের প্রকৃতি সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান লাভের জন্য ১৯২১ ও ১৯৯২ সনে তিনি বার্মা, কলিকাতা, পন্ডিচেরী, দিল্লি, আগ্রা ও আজমীর ভ্রমন করেন ও বহু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। তিনি বেলায়তের মিরাজহীন কোন লোকের মাজার করার বিরুদ্ধে মত পোষণ করেন। তিনি ভক্তের বাড়ী বাড়ী গিয়ে মুরীদ বানানো ও নজরানা নেয়ার কাজকে ঘৃণা করতেন। তিনি গাউছিয়ত নীতি বিরুদ্ধ ছায়র (সফর) পীরি করেননি। তিনি বলতেন পরিস্কার হওয়ার জন্য মানুষ পুকুরের কাছে যায়, পুকুর মানুষের নিকট যায় না। তিনি বলতেন, “যে বালি জল শোষণ করে তাতে কোন উদ্ভিদ জন্মে না”। প্রকৃতপক্ষে, অর্থলিপ্সু পীরের নিকট থেকে মুরীদ মুক্তির দিশা পেতে পারে না। অছি-এ-গাউছুল আজম ছিলেন রেছালত ও রসুল করিম (সঃ)-এর পদাঙ্ক অনুসারী এবং গাউছিয়ত নীতির ধারক, বাহক ও পরিপূরক হিসেবে পূর্ণ মানবতা প্রাপ্ত মহান ওলী। তিনি ভূয়া পীরি, মুরীদি ও ফকিরীর বিরুদ্ধে কঠোর ও প্রতিবাদ মুখর ছিলেন। উল্লেখ্য, মাইজভান্ডার দরবার শরীফের তাঁর পবিত্র মাজার একমাত্র ব্যতিক্রম হিসেবে কালের সাক্ষী হয়ে আছে এবং মাইজভান্ডার দরবার শরীফের শরাফতের আসল স্বরূপ ঘোষণা করছে।
তিনি প্রায়শঃ বলতেন, মাইজভান্ডার দরবার শরীফের কোন মাজারের বাহ্যিক শোভা যেন তাঁর মুনিবের (অর্থাৎ হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (রঃ)-এর) মাজারের শোভার চাইতে বেশী না হয়।
মাইজভান্ডার দরবার শরীফের সুরক্ষায় খাদেমুল ফোকরার অবদান পর্যালোচনার মাধ্যমে যে সত্যকে জানতে ও বুঝতে পেরেছি তা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের কাছে তুলে ধরে সকলকে কুসংস্কার বর্জিত মহাসত্যের দিকে অনুপ্রাণিত করতে হবে। তিনি গ্রামে ও গঞ্জে আঞ্জুমানে মোত্তাবেয়ীনে গাউছে মাইজভান্ডারী নামে যে সংগঠন ও তৎসংলগ্ন জ্ঞানভান্ডার নামে যে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে গেছেন উহার মাধ্যমে আমরা এ মহান কাজ সমাধা করতে পারি। এ প্রতিষ্ঠানটির বিকাশে ও সুরক্ষায় আমাদের সকলকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সভা, আলাপ, আলোচনা, পত্র-পত্রিকা, সাময়িকী, গবেষণা ও তাঁর রচিত কেতাবাদির মাধ্যমে মুক্তিকামী মানব সমাজের দোর গোড়ায় মহান সত্যকে পৌছিয়ে দেয়া সম্ভবপর হবে। আসুন সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে আজ আমরা এ মহান আদর্শ ও প্রেরণায় উদ্ভুদ্ধ হই। তাঁর মহান আদর্শকে বাস্তবায়িত করে তাঁর প্রতি যোগ্য সম্মান প্রদর্শন করি। মাইজভান্ডার দরবার শরীফের মহান শরাফতকে জগৎ ও জীবনে, জীবনধারা ও কর্মপদ্ধতিতে সুপ্রতিষ্ঠিত করি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের এ মহৎ প্রচেষ্টায় সহায় হউন। আমিন
No comments:
Post a Comment